Advertisement

ঘোড়ার ‘রিমান্ড’ দেখতে যেতে পারেন তুলসীপুরে

জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট, ২০২৫

ঘোড়ার ‘রিমান্ড’ দেখতে যেতে পারেন তুলসীপুরে
ঘোড়ার ‘রিমান্ড’ দেখতে যেতে পারেন তুলসীপুরে

আশরাফুল ইসলাম আকাশ

বৃষ্টি থামলো। পা বাড়ালাম তুলসীপুর ডিগ্রি কলেজ মাঠে। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে এই মাঠে বসছে দেশের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার হাট। সবচেয়ে প্রাচীন ও সুলভ মূল্যে পছন্দের ঘোড়া পাওয়া যায় বলে এই হাটের খ্যাতি দেশজুড়ে। হাটের দিন ঘনিয়ে এলেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ঘোড়ার ক্রেতা, বিক্রেতা ও পাইকাররা।

জামালপুর সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে রশিদপুর ইউনিয়নের তুলসীপুর গ্রাম। এই গ্রামের কোলেই গড়ে উঠেছে ছোট্ট একটি হাট। এখান থেকে পূর্বদিকে আধা-পাকা সড়ক ধরে কয়েক মিনিটের পথ। তাহলেই দেখা যাবে কলেজ মাঠ, সেদিকেই এগোচ্ছি। হঠাৎ দলবেঁধে মাথার ওপর উড়ে এলো ঘনকালো মেঘ। মুহূর্তেই ঝমঝম করে নামলো বৃষ্টি। যদি এই বৃষ্টি আজ ছুটি না নেয়, তাহলে ঢাকায় ফিরতে হবে শূন্য হাতে! তবে ভাগ্যটা সেদিন সুপ্রসন্ন ছিল।

ঘোড়ার ‘রিমান্ড’ দেখতে যেতে পারেন তুলসীপুরে

ঘোড়ার ‘রিমান্ড’ দেখতে যেতে পারেন তুলসীপুরে

সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার বসে ঐতিহ্যবাহী তুলসীপুরের ঘোড়ার হাট। দীর্ঘ ৫ দশক ধরেই চলছে এই নিয়ম। তবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও হাটে তেমন ঘোড়ার দেখা নেই। এখন পর্যন্ত যা ঘোড়া এসেছে; তাতে মনকে তৃপ্ত করা যায় না। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখটা গোমড়া করে অপেক্ষায় বসে রইলাম। আকাশ থেকে কালো মেঘগুলো সরে যেতেই হাটে ঘোড়ার আনাগোনা বাড়তে থাকলো। কলেজ মাঠের ঢাল বেয়ে খটখট শব্দ করে নেমে আসছে বিভিন্ন জাতের ঘোড়া।

বিক্রি করতে ঘোড়াগুলো মিনি ট্রাক, নসিমন এবং ব্যাটারিচালিত অটোতে করে আসতে শুরু করেছে। জায়গা খুঁজে খুঁজে সারিবদ্ধভাবে ঘোড়াগুলো বেঁধে রাখছেন খামারিরা। কোথাও কোথাও জটলা বেঁধেছে। আধঘণ্টার মধ্যে নানা জাতের ঘোড়ায় পরিপূর্ণ হয়ে গেলো কলেজ মাঠ। হাট সংশ্লিষ্টরা জানালেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হাটে ঘোড়া আনা হয়। এর মধ্যে টাট্টু, বাহাদুর, তাজিয়া, রাজা, রানি ও পারলে ঠেকাও নামের ঘোড়াগুলো ক্রেতাদের নজরে থাকে। এসব ঘোড়া বয়স ও মানভেদে ২ হাজার থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।

ঘোড়ার ‘রিমান্ড’ দেখতে যেতে পারেন তুলসীপুরে

ঘোড়ার ‘রিমান্ড’ দেখতে যেতে পারেন তুলসীপুরে

ক্রেতাদের দর কষাকষিতে জমে উঠলো তুলসীপুর হাট। বাজেটের মধ্যে ঘোড়া কিনতে অনেক ক্রেতাই এসেছেন যশোর, টাঙ্গাইল, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর ও সিলেটের মতো শহর থেকে। মজার ব্যাপার হলো, পছন্দের ঘোড়া কেনার আগে তার শক্তি পরীক্ষা করবেন ক্রেতারা। স্বাচ্ছন্দ্যে সেই কাজটিই শুরু করলেন বিক্রেতারা।

এ হাটে ঘোড়ার শক্তি পরীক্ষা করতে দারুণ এক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। ঘোড়াকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। গাড়ির ওপর ভাড়ি বস্তু কিংবা ৫-৭ জন মানুষসহ হাটু কাদা-পানিতে নামিয়ে দেওয়া হয় ঘোড়াগুলোকে। কঠিন এ পরীক্ষা উতরে যেতে পারলেই ভালো দাম মিলবে ঘোড়ার। হাটে অবশ্য সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় টাট্টু ঘোড়া। একটু ধীরগতির হলেও বেশ ভারী কাজ করতে সক্ষম এ জাতের ঘোড়া। কাঁধে মালবোঝা গাড়ি নিয়ে মাইলের পর মাইল ছুটতে পারে।

কলেজ মাঠের পাশেই রিমান্ডের জন্য ৫-৬ ফিট গভীর একটি খাদ খনন করা হয়েছে। যেটি পুরোপুরি কর্দমাক্ত পানির রাস্তা, বালুর রাস্তা, উঁচু-নিচু খাদ দ্বারা পরিপূর্ণ। এখানে নামিয়েই ঘোড়ার শক্তি পরীক্ষা করা হয়। তবে বৃষ্টির পানিতে সেই খাদ টইটুম্বুর। বিকল্প হিসেবে পাশের একটি পতিত জমিতে নিয়ে ক্রেতাদের পছন্দের ঘোড়াগুলোকে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ কলেজ মাঠে ঘোড়দৌড় দিয়ে প্রাণীটির তেজ পরখ করে নিচ্ছেন। একের পর এক সাদা, কালো, লাল রঙের ঘোড়াগুলো মাঠের ধার ঘেঁষে ছুটছে। চাবুক পড়তেই টগবগিয়ে ঘোড়ার গতি বাড়ছে।

হাট কিছুটা জমে উঠতেই ফের বৃষ্টি শুরু। মুহূর্তেই কলেজ মাঠ অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেল। কারো আশ্রয় হলো কলেজ মাঠে, কারো ঠাঁই হলো ছোট টং দোকানে। ঝিরি বৃষ্টির শীতল হাওয়ায় কেউ পান করছেন চা, কারো হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। এই ঝিরি বৃষ্টি যেন সবাইকে কিছুটা বিশ্রামের সাথে বিকেলের নাস্তার সুযোগ এনে দিলো। মেঘ-বৃষ্টি সরে যেতেই আরেক দফা শুরু হলো হাট। রিমান্ড আর যাচাই-বাছাই শেষে হাত বদল হলো ঘোড়ার মালিকের। কেউ ফিরলেন শখের ঘোড়া বিক্রি করে, কেউ ঘরে ফিরছেন পছন্দের ঘোড়া নিয়ে।

ঘোড়ার ‘রিমান্ড’ দেখতে যেতে পারেন তুলসীপুরে

ঘোড়ার ‘রিমান্ড’ দেখতে যেতে পারেন তুলসীপুরে

তুলসীপুরের ঐতিহ্যবাহী এ হাটে শুধু ঘোড়া নয়, একে নিয়ন্ত্রণ করতে পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম। হাটের এক কোণে কড়ি গাছের নিচে বসে কয়েকজন বিক্রি করছেন জিন, লাগাম, স্যাডেল ও হার্নেসের মতো সরঞ্জাম। এসব বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন স্থানীয় কামাররা। হাটে ঘোড়া বিক্রি বাড়লে তাদের আয়ের অভাব হয় না। তবে হাটবার মন্দ গেলে কপালে পড়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।

তুলসীপুর হাটের কোষাধ্যক্ষ জানালেন, বৃহস্পতিবার এ হাট বসে। দুপুর থেকে শুরু হয়ে চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। হাটে যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে যথেষ্ট ব্যবস্থা করা আছে। চাইলে দূরের পথ থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা এখানে রাত কাটাতেও পারেন। প্রতি হাটে ৫০-৮০টি ঘোড়া বিক্রি হয়।

যেভাবে যাবেন
ঢাকার মহাখালী থেকে জামালপুর সদরের বাস ধরতে হবে। জামালপুরগামী যে কোনো বাস আপনার জন্য ভালো পছন্দ হতে পারে। গাড়ির মানভেদে ২০০-২৫০ টাকার মধ্যে টিকিট পেয়ে যাবেন। জামালপুর সদর পৌঁছে সেখান থেকে রশিদপুর ইউনিয়নের তুলসিপুর গ্রামের সিএনজি পাওয়া যায়। এজন্য জনপ্রতি খরচ করতে হবে ৩০ টাকা। বাজারে নেমে কয়েক মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ পাড়ি দিলেই চোখে পড়বে ঐতিহাসিক ঘোড়ার হাট।

Lading . . .