প্রকাশ: ২৮ আগস্ট, ২০২৫

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে সুনামগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর যেন প্রকৃতির অনন্য জলরাজ্য। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত হাওরকে অনেকে বলেন বাংলাদেশের ছোট কাশ্মীর। বর্ষায় বিশাল জলরাশি আর শীতে হাজারো পরিযায়ী পাখির কলকাকলি টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা।
ভোরের প্রথম সূর্যকিরণ যখন পানির গায়ে সোনালি আলো ফেলে; তখন মনে হয় যেন হাওরের বুকটাই জ্বলজ্বল করছে। নৌকা ছুটে চলে জলের বুক চিড়ে। দূরে পাহাড় আর মেঘ একাকার হয়ে গেছে। চারপাশে শুধু জল আর জল, মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে ছোট ছোট দ্বীপ বা টিলা। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে বলা হয় ‘টংর’। টংরগুলোই অনেক সময় স্থানীয়দের বসতি, আবার কোথাও কোথাও ফসল ফলানোর জমি। এ ছাড়া হাওরের বুকে আছে ‘ওয়াচ টাওয়ার’।

হাওরের মাঝপথে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলে মনে হয়, শহরের কোলাহল আর ব্যস্ততার পৃথিবীটা বহু দূরে। শুধু শোনা যায় পানির কলকল শব্দ, হাওরের হালকা বাতাস আর উড়ে বেড়ানো পাখিদের মধুর ডাক। অন্যদিকে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা প্রায় ৩০টি ঝরনা এ হাওরে মিশেছে। প্রকৃতির এমন নির্মলতা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন। এখানে এসে বোঝা যায়, প্রকৃতির কাছে যাওয়ার মানে। এই প্রকৃতির মাঝেই ভেসে ভেসে খাওয়া যায় গরম গরম চা।
শুধু প্রকৃতি নয়, টাঙ্গুয়ার হাওরের সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো জীবনের গল্প। এখানকার শত শত স্থানীয় মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে হাওরের ওপর নির্ভরশীল। মাছ ধরা, শাপলা কুড়ানো কিংবা নৌকা চালানোই তাদের জীবিকার অংশ। এখানে আছে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ। সকালে দেখা যায়, স্থানীয় জেলেরা ডিঙ্গি নৌকায় জাল ফেলছেন। আবার কোথাও বাচ্চারা শাপলা কুড়িয়ে আনছে। পর্যটকেরা চাইলে শাপলা-শালুকের মাঠে গিয়ে ছবি তুলতে পারেন। গ্রামের ঘরে গিয়ে সরল অথচ মধুর আতিথেয়তা উপভোগ করতে পারেন।

টাঙ্গুয়ার হাওরের আরেক সৌন্দর্য হলো শীতকালে পরিযায়ী পাখির আগমন। এ সময় ভিড় জমায় প্রায় ২০৮ প্রজাতির অতিথি পাখি। এশিয়া, সাইবেরিয়া কিংবা হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজারো পাখি আশ্রয় নেয়। তখন নানা জাতের হাঁস, বক আর অন্যান্য জলচর পাখির দল ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। পাখি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক আসেন। এ যেন প্রকৃতির এক প্রাণবন্ত উৎসব।
আরও পড়ুন
গরমে যখন সূর্যের তেজ চড়ে, তখন হাওরের জল মানুষকে টেনে নেয়। নৌকায় বসে মাছ ধরা কিংবা সাঁতার কাটা ভ্রমণকারীদের কাছে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যারা দলবেঁধে আসেন; তাদের কাছে টাঙ্গুয়ার হাওর এক স্বপ্নের ভ্রমণ। অনেকে আবার বন্ধুদের নিয়ে নৌকায় রাত কাটান। চাঁদের আলোতে হাওরের বুক পেরিয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।

ভ্রমণ শেষে মনে হয়, হাওর শুধু প্রকৃতির নয়, মানুষেরও আশ্রয়। জীবনের একাংশ। প্রকৃতি, মানুষ আর সংস্কৃতির মেলবন্ধনই হাওরকে করে তুলেছে অনন্য ভ্রমণগন্তব্য। টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে প্রথমে যেতে হবে সুনামগঞ্জ শহরে। ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সেখান থেকে স্থানীয় অটো বা গাড়িতে তাহিরপুর ঘাটে গিয়ে নৌকা ভাড়া নিয়ে হাওরের যাত্রা শুরু। অথবা নেত্রকোনা গিয়ে সেখান থেকে পানিপথে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর যেতে পারবেন।
কাঠের ছোট নৌকা থেকে শুরু করে বড় ইঞ্জিনচালিত নৌকা, সব ধরনের সুবিধাই পাওয়া যায়। যারা দীর্ঘসময় এবং আরামে ভ্রমণ করতে চান, তাদের জন্য আছে ডাবল ডেকার হাউজ বোট। ভাড়া নির্ভর করে নৌকার আকার ও মৌসুমের ওপর। ঢাকা থেকে একদিনের ভ্রমণে সেখানকার সব সৌন্দর্য ঘুরে দেখতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার মতো খরচ হবে। ট্যুর গ্রুপের সাথে গেলে খরচ কিছুটা কমে আসবে।

বর্ষায় হাওরের জলরাশি ভ্রমণকারীদের বিমোহিত করে। তবে শীতকালে পাখি দেখার সুযোগও অসাধারণ। বর্ষা ও শীত দুই ঋতুতেই টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য ভিন্ন রূপে ধরা দেয়। জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বে সরকার ১৯৯৯ সালে একে ‘ইসিএ’ ঘোষণা করে। ২০০০ সালে এটি ‘রামসার সাইট’র তালিকাভুক্ত হয়।
টাঙ্গুয়ার হাওর একদিকে প্রকৃতির জলে ভেসে থাকা কবিতা, অন্যদিকে মানুষের জীবনের গল্প। যারা একবার এখানে এসেছেন; তারা বোঝেন এ ভ্রমণ শুধু চোখে দেখা নয়, মনের গভীরে জমে থাকা স্মৃতি, যা সহজে ভোলা যায় না। যদি আপনি টাঙ্গুয়ার হাওরের ভ্রমণ পরিকল্পনা করেন, তবে স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিতে পারেন। তারা হাওরের বিভিন্ন স্পট যেমন নীলাদ্রি লেক, শিমুল বাগান, যাদুকাটা নদী ইত্যাদি ঘুরিয়ে দেখাতে পারবেন।
আরও পড়ুন