কোচ কিবুর ঠান্ডা মাথা আর নিখুঁত ম্যানেজমেন্টে সাফল্য
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট, ২০২৫

পার্থ দত্ত
ঝরঝরিয়ে তখন ঝরছে বৃষ্টি। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল না। কিন্তু বিদ্যুৎ চমকের মতোই ঘনঘন ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় যেন একটু থমকেই গেলেন জবি জাস্টিন, লুকা মায়সেন, রবিলাল মান্ডিরা।
শুক্রবার বিকেলে যুবভারতীর ট্রেনিং গ্রাউন্ডে বৃষ্টির মধ্যেই উপচে পড়া মিডিয়ার ভিড়। ডায়মন্ড হারবার এফসির ফুটবলাররা তো এসব দেখতে তেমন অভ্যস্তই নন। মিডিয়ার ভিড় থাকে তো তিন প্রধানের প্র্যাক্টিসে। ডুরান্ড ফাইনালে ওঠায় রাতারাতি টিম ডায়মন্ড হারবার যেন বাংলার ফুটবলের ফোর্থ পিলার।
প্র্যাক্টিসে নামার একটু আগে মিডিয়া সেন্টারে বিক্রমজিৎ সিংকে পাশে নিয়ে বসে ডায়মন্ড হারবার এফসির কোচ কিুব বিকুনিয়ার গলায় বাংলা নিয়ে আবেগ। বলছিলেন, ‘কাল আপনারা সবাই মিলে আমাদের সাপোর্ট করুন। কারণ ডুরান্ড কাপ ফাইনালে তো আমরা বাংলাকে প্রতিনিধিত্ব করছি। ট্রফিটা আমরা বাংলার জন্যই জিততে চাইছি। তাই ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডানের সমর্থকদেরও পাশে চাই।’
চার বছর ধরে ডায়মন্ড হারবারের কোচিং করিয়ে স্প্যানিশ কোচ কিবু যেন বাঙালিই হয়ে গিয়েছেন। অন্য বিদেশি কোচদের মতো তাঁর সাপোর্ট স্টাফ টিমে কোনও বিদেশি নেই। সবাই দেশি। তাঁদের যথাযথ সম্মান দিয়েই কাজ আদায় করে নেন কিবু। অন্য বিদেশিদের মতো অহংকারী বা মেজাজিও নন তিনি। ঠাণ্ডা মাথায় সবাইকে নিয়ে চলার ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। ফলে ডায়মন্ড হারবার টিম সুখী পরিবার। যা রবিবার রাতে নর্থইস্ট ইউনাইটেডকে হারিয়ে ডুরান্ড কাপ ছোঁয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্লাস পয়েন্ট।
এই ক্লাবে দীর্ঘদিন কোচিং করিয়ে আই লিগ থ্রি, আই লিগ টু জিতেছেন কিবু। আই লিগ তিনি পেয়েছিলেন মোহনবাগানে কোচিং করে। কিন্তু ডুরান্ড কাপ এখনও অধরা এই স্প্যানিশ কোচের কাছে। ২০১৯ সালে মোহনবাগানকে নিয়ে তিনি ডুরান্ড কাপের ফাইনালে উঠলেও যুবভারতীতে হারতে হয়েছিল গোকুলম এফসির কাছে। এ বার সেই যুবভারতীতেই ফের ডুরান্ড কাপ ছোঁয়ার হাতছানি।
একটা টিম চার বছরের মধ্যে রাজ্যের ফুটবলের চতুর্থ শক্তি হয়ে তিন প্রধানকে কী করে টক্কর দিচ্ছে? জবাবে উঠে আসছে চারটে ফ্যাক্টর। এক–ছোট মাপের টিম ম্যানেজমেন্ট। কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাই মতবিরোধ তৈরি হয় না। দুই, টিমের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দর্শন। তিনি টিমের পরিকাঠামোগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলেও টেকনিক্যাল ব্যাপারে কোচ ও ম্যানেজমেন্টকেই পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। তিন, অন্য ক্লাবে ফুটবলার বাছাইয়ে এজেন্ট–রাজ বড় ভূমিকা নেয়। কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘কোচের সঙ্গে আলোচনা করে ফুটবলার বাছাই করি আমরাই। এজেন্টের ভরসায় আমরা টিম গড়ি না।’ চার, উপযুক্ত পরিকাঠামো। একটা টিমের ভালো ফলের পিছনে প্রধান প্রয়োজন ভালো মাঠ। ডায়মন্ড হারবার শুরুর লগ্ন থেকেই ফুটবলারদের সেই সুযোগ দিয়েছে নিজস্ব মাঠ বানিয়ে। সঙ্গে ফুটবলারদের নিয়ে সুখী সংসার বানাতে তারা ফুটবলারদের এক নামকরা হোটেলে বছরের পর বছর রেখেছে। ফলে ফুটবলারদের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে দারুণ।
কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশনে যাত্রা শুরু করা ডায়মন্ড হারবার এর মধ্যেই একের পরে এক সিঁড়ি টপকে এশিয়ার প্রাচীনতম ট্রফি জয়ের সামনে। শুক্রবার টিমের প্র্যাক্টিস দেখার ফাঁকে আকাশ বলছিলেন, ‘আজ রাতে আর ঘুমোতে পারব না। কাপটা ছোঁয়ার অপেক্ষায় মুখিয়ে আছি।’ শীর্ষ কর্তা টেনশনে থাকলেও ডায়মন্ড হারবারের ফুটবলারদের মধ্যে সেই টেনশনের ছোঁয়া দেখা গেল না। বরং ফাইনালে ওঠাটাকে দারুণ উপভোগ করছেন জবিরা। মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে টিমের সিনিয়র ডিফেন্ডার বিক্রমজিৎ বলছিলেন, ‘আমরা চাপে নেই। তিন প্রধান যা পারেনি, আমরা সেটাই করে ফেলেছি। ফাইনালে উঠেছি। এটা কাপ জয়ের জন্য আমাদের আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।’
২০১০ সালে ডুরান্ড কাপে প্রথমবার খেলার সুযোগ পেয়েই ফাইনালে উঠেছিল কলকাতার চিরাগ ইউনাইটেড। ফাইনালে তারা জেসিটিকে হারিয়েছিল ১–০। মোহনবাগানের ঘরের ছেলে সুব্রত ভট্টাচার্যের কোচিংয়েই ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ে গড়েছিল বর্তমানের ইউনাইটেড স্পোর্টস। ২০২০ সালে মোহনবাগানকে আই লিগ জেতানো কোচ কিবুর সামনেও নয়া অধ্যায় লেখার সুযোগ। প্রথমবার এই টুর্নামেন্টে খেলতে নামা ডায়মন্ড হারবার এফসিকে নিয়ে।