ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজ এখন ভোগান্তির প্রতিচ্ছবি
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ঢাকার ফার্মগেট নগরজীবনের ব্যস্ততম একটি কেন্দ্র। সকাল-বিকেল অফিসগামী মানুষের ভিড়, শিক্ষার্থীদের চলাচল, কেনাকাটা-সব মিলিয়ে এই এলাকার সড়ক যেন সব সময় মহাব্যস্ত। পথচারীদের নিরাপদ পারাপারের জন্য এখানে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি দৃষ্টিনন্দন ফুটওভার ব্রিজ। জাতীয় সংসদ ভবনের আদলে তৈরি এই চারমুখী ব্রিজ এখন হকারদের দখলে।
প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ফুটওভার ব্রিজে আছে চলন্ত সিঁড়ি, ছয়টি ভিউ পকেট, আরামদায়ক দাঁড়ানোর জায়গা-সব মিলিয়ে যেন এক আধুনিক স্থাপনা।

ফুটওভার ব্রিজটি পথচারীদের জন্য নিরাপদ পারাপারের ব্যবস্থা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। হকারদের দখলে বাজারে পরিণত হয়েছে। ব্রিজের ভেতরে সারি সারি দোকান। এমনকি সিঁড়ির মুখেও অবাধে চলছে হকারদের বেচাকেনা। ছিন্নমূল মানুষ ও ভিক্ষুকদের অবস্থানেও পথচারীদের চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি সড়ক দিয়েই পারাপার হচ্ছেন, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও যানজট।
২০২৩ সালের অক্টোবরে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হওয়া এই ফুটওভার ব্রিজটি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড। প্রকল্প ব্যয় বহন করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার মধ্যে এটিই সবচেয়ে প্রশস্ত ফুটওভার ব্রিজ। ১৩২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮ ফুট প্রস্থে নির্মিত এটি। এর ছয়টি ভিউ পকেট থেকে আশপাশের রাস্তা ও দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগও রাখা হয়েছে।

তবে দৃষ্টিনন্দন নকশা, প্রশস্ত কাঠামো কিংবা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা কোনোটিই এখন আর পথচারীদের কাজে আসছে না। সুউচ্চ এই ওভারব্রিজ বর্তমানে নগরের আরেকটি ‘বাজার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন
ফুটওভার ব্রিজের দোকানে কি আছে আপনার জন্য?
ফুটওভার ব্রিজে পা রাখলেই চোখে পড়ে সারি সারি দোকান। কেউ বসেছেন পোশাক নিয়ে, কেউ বিক্রি করছেন জুতা আবার কেউ বা নিয়ে বসে আছেন মোবাইল ফোনের নানা সামগ্রী। সিঁড়ির মুখেও বসে আছেন বিক্রেতারা। তার ওপর ছিন্নমূল মানুষের অবস্থান, ভিক্ষুকদের ভিড়-সব মিলিয়ে চলাচল কার্যত দুর্বিষহ।

পথচারীরা জানান, ভিড়ের কারণে ফুটওভার ব্রিজে হাঁটার জায়গা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। তাই অনেকে বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি সড়ক পার হচ্ছেন। এতে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা। যানজটও বাড়ছে।
ফুটওভার ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে কথা হয় সাদিয়া আক্তার নামের এক কর্মজীবী নারীর সঙ্গে। প্রতিদিন ফার্মগেট থেকে বাস ধরতে হয় তাকে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে জাগো নিউজকে বললেন, ‘এত টাকা দিয়ে যদি দোকান বসানোর জন্য ফুটওভার ব্রিজ বানানো হয়, তবে আমাদের উপকার কী হলো? ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হতে হয়।’
শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান বলেন, ‘চলন্ত সিঁড়ি থাকলেও তা প্রায়ই বিকল থাকে। হকারদের কারণে ভেতরে ঢুকতেই ভয় লাগে। এটাকে কোনো ফুটওভার ব্রিজ মনে হয় না, এখানে এলেই মনে হয় কোনো খোলাবাজারে চলে এসেছি।’

শুধু ফার্মগেটের ফুটওভার ব্রিজই নয়, রাজধানীর আরও বেশ কিছু স্থানে একই চিত্র দেখা যায়। মহাখালী, মধ্য বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, নতুন বাজার, নর্দ্দা, যমুনা ফিউচার পার্ক, মিরপুর ও বাংলামোটরের ফুটওভার ব্রিজগুলোতেও হকারদের রাজত্ব। কিন্তু এসব স্থানে ফার্মগেটের মতো ব্যাপক হারে দোকানপাট বসেনি। তবে কোথাও পাঁচ-সাতটি, কোথাও ১০-১২টি দোকান গড়ে উঠেছে।
এছাড়া প্রতিটি ফুটওভার ব্রিজেই চোখে পড়ে ছিন্নমূল মানুষের অবস্থান। কেউ শুয়ে আছেন, কেউ আবার ভিক্ষা করছেন। শুধু তাই নয়, ফুটওভার ব্রিজে ওঠা-নামার মুখেও ফুটপাতে সারি সারি দোকান। এতে নিরাপদ পারাপারের জন্য নির্মিত এসব ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে গিয়ে প্রতিদিনই ভোগান্তিতে পড়ছেন পথচারীরা।
পথচারীদের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় চলাচলের লক্ষ্যে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ২০২১ সালে প্রণয়ন করেছিল , ‘পথচারী নিরাপত্তা খসড়া প্রবিধানমালা’। তবে সেখানে ফুটওভার ব্রিজ নয়, গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ফুটপাতের মানোন্নয়নে। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সেই নীতিমালা এখনও বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।

প্রবিধানমালায় উল্লেখ করা হয়, ফুটপাতের নকশা ও আকার এমন হতে হবে যেন পথচারীরা নির্বিঘ্নে ও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারেন। কর্মক্ষেত্র, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছতে যেন কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে না হয়, সে জন্য ফুটপাতকে রাখতে হবে প্রশস্ত, সমতল ও ধারাবাহিক। এছাড়া বিদ্যমান অবকাঠামো ও ল্যান্ডস্কেপিং অন্তর্ভুক্ত করে ফুটপাতে হাঁটার পরিবেশকে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। নিরাপদে এবং স্বল্প সময়ে রাস্তা পারাপারের সুযোগ তৈরি, পথচারীর নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও পর্যাপ্ত আলোকসজ্জার বিষয়টিও প্রবিধানমালায় বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।